Friday, May 17, 2013

আমি কে?


আমি কে?

by তেরো

জানালার পাশে বসে রুটির শেষ টুকরোটিতে কামড় বসালাম আমি। রাত হয়ে আসছে। এখন ঘুমোতে হবে। কালকে সকালে উঠেই আমাকে এই শহর ত্যাগ করতে হবে। এখন প্রশ্ন আমি কে? আমি একজন পথিক। আমি ঘুরে বেড়াই এই শহর থেকে এই শহর, এই গ্রাম থেকে এই গ্রামে। কেউ পথিক কে আপ্যায়ন করে, কেউ বিরক্ত হয়। কখনো কখনো আমি অর্থের বিনিময়ে ছোটখাটো কাজ করে দেই। এভাবে আমার হয়েই যায়।

এই শহরে আছি আমি বেশ কিছুদিন। এখানে আমি একটি কাজ পেয়েছিলাম। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে দেশলাই বিক্রীর কাজ। একসপ্তাহ ধরে এই কাজটি আমি করে আসছি। এতে আমার কিছু অর্থ সমস্যা দূর হয়েছে। তাই আমি চাইলে কালকেই এই শহর ত্যাগ করতে পারবো।

আমি যে আসলে একলা চলাফেরা করি তাও না। আমার সাথে আমার একান্ত বিশ্বস্ত সংগী আছে। আমার কুকুর চার্লি। চার্লি আমার সাথে আমার পথিকজীবনের শুরু থেকেই আছে। আমার জন্ম হয়েছিলো এক গম্ভীর শহরে।সেই শহরের এমন এক বাড়িতে আমি জন্মেছিলাম যার কোনো জানালা ছিলো না। আপাতদৃষ্টিতে যাও ছিলো তাকে আসলে জানালা বলা যায় না। চারপাশে ছিলো সুউচ্চ ভবন। সেই জানালা দিয়ে কখনোই আকাশ দেখা যেতো না। চাঁদ দেখা যেতো না, মেঘ দেখা যেতো না। আমি খুব বিশ্রীভাবে বড় হচ্ছিলাম। আমি ছিলাম বিরক্ত ও হতাশ। অবশেষে আমার হতাশার ছাপ আমার কাজকর্মেও দেখা পেলো। আমি ক্রমাগত আমার পড়াশোনাতে পিছিয়ে গেলাম। যে শহরে থাকতাম সে শহরে পিছিয়ে যাওয়া মানে বিরাট ব্যাপার। সেখানে সবার মাঝে তীব্র প্রতিযোগীতা। সবাইকেই ভালো করতে হবে। সেখানে মায়া-ভালোবাসা ছিলো না, ছিলো শুধু প্রতিযোগীতা। আমার মা বাবা ধীরে ধীরে আমার উপর হতাশ হতে লাগলেন। এখানে হতাশের কারন উপড়ে ফেলা হয়। নির্মম শহর। আমি টের পেলাম আমাকেও হয়তো উপড়ে ফেলা হবে। আমাকে কিছুদিন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। উদ্ভট চেহাড়ার কিছু মানুষ আমাকে বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদ করতো।

সেদিন ছিলো এক বিকেল। আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আকাশে তাঁকালাম। আকাশ ভরা মেঘ। অবিরত চলছে মেঘগুলো। আমি অজান্তেই বলে ফেললাম, আমি যদি মেঘ হতে পারতাম।
সিদ্ধান্ত আমি নিয়েই ফেললাম, আমাকে পালাতে হবে। শীঘ্রই পালাতে হবে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদী জোগাড় করতে লাগলাম ধীরে ধীরে। সারাজীবনের অর্থ, কিছু খাওয়া-পানি, মোটা কাপড়, শীতের কাপড়, সুরক্ষার জন্য অস্ত্র প্রভৃতি নিয়ে আমি একদিন বের হয়ে পড়লাম। সেদিন ছিলো এক ঝকঝকে রাত, আকাশে কোনো মেঘ ছিলো না, তারারা মিটমিট করে জ্বলছিলো সারা আকাশজুড়ে। আমি চুপিচুপি সেই ভয়ংকর গম্ভীর শহর থেকে পালালাম। শুরু হলো আমার পথিক জীবন।

আমি আমার জীবনের লক্ষ্য নিয়ে সন্দিহান ছিলাম এবং এখনো আছি। আমি পথিক হয়ে আসলে কোথায় যাচ্ছি, এর শেষ কি হবে তা আমাকে মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তুলে। কিন্তু আমি হেঁটে চলছি অবিরত। আমি নিজেকে মেঘের সাথে তুলনা করতে পছন্দ করি, একদিন সেও বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। আমিও ঝরে পড়বো। কিন্তু ঝরে পড়ার আগ পর্যন্ত আমি দেখে যেতে চাই যতটুকু সম্ভব।
একজন মেয়ে পথিক হিসেবে আমাকে বেশ সাবধানতার সাথে চলাফেরা করতে হয়। তবে আমার সাথে সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র আছে, আমি টিকে থাকার জন্যই তাদের ব্যবহার বেশ ভালো করেই রপ্ত করেছি দিনকে দিন। অতিরিক্ত হিসেবে সাথে আছে চার্লি। চার্লি প্রয়োজনে হিংস্র হতে পারে। অবশ্য বহুদিন রোদে ঘুরে আমার গায়ের রঙ তামাটে প্রায় , আমার ছোট চুল এবং ভারী পোশাকের কারণে আমি সাধারণত থাকি মানুষের মনোযোগের বাইরে। মনোযোগের বাইরে থাকলে সবকিছু মনোযোগ দিয়ে দেখা সম্ভব হয়। আমি তাই শহর ঘুরে ঘুরে অভিজ্ঞতা বানাই।

বেশ ভোরবেলা আমি বর্তমান শহরটি ত্যাগ করলাম। এখন আমার সামনে দুটি রাস্তা। আমি ভাবতে লাগলাম কোন রাস্তা দিয়ে চলবো। পথিক হয়ার কিছু সুবিধা আছে , কোনো তাড়া নেই, কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। শুধু চলতে থাকো, চলতেই থাকো। আমি ডানদিকের রাস্তা বরাবর হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর গিয়েই আমি এক শহরের দেখা পেলাম। সে শহরের প্রবেশদ্বারের রক্ষী আমাকে দেখে হতাশ হয়ে দরজা খুলে দিলো। আমি শহরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই এক শবযাত্রার সম্মুখীন হলাম। কালো পোশাকধারী দুখী অনেকেই সাথে সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। হয়তো তারা তার নিকট আত্মীয়,বন্ধু,প্রিয় মানুষ। আমিও দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিন্তু এই শহরের পরিবেশটা গুমোট।এখানে পর্যাপ্ত আলো আছে,বাতাস আছে তাও আমার কাছে এক অদ্ভুত অন্ধকার লাগছিল সবকিছু।

আমি একটি সস্তা হোটেল খুঁজতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম। কিন্তু সেখানকার মানুষগুলোর চেহাড়াতে তীব্র বিষাদ।আমি জানতে পারলাম এ শহরের নাম হলো বিষাদের শহর। এখানে নেই কোনো হাসি,নেই আনন্দ,আছে শুধু বিষাদ ও দূঃখ। হোটেলের পরিচালক আমাকে জানালো এখানের জনসংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। অনেকেই বিষাদ থেকে বাঁচতে মৃত্যুকে সমাধান হিসেবে বেছে নিচ্ছে। দু’দিন আমি আর চার্লি এই শহরের রাস্তাতে রাস্তাতে ঘুরলাম বেশ, অসংখ্য শবমিছিল,মৃত্যু চারদিকে। আমাদের পক্ষে এই শহরে থাকা সম্ভব না, আমরা দ্রুতই সেই শহর ত্যাগ করলাম। দ্বাররক্ষী আমাকে বললো, "আপনি তাড়াতাড়ি পালান, আপনি ভালো থাকুন"।
কিছুদিন পর আমরা আরেকটি শহরে এসে পৌছালাম। এই শহরের দ্বাররক্ষী আমাকে হাসতে হাসতে দরজা খুলে দিলো। আমি প্রবেশ করলাম সে শহরে। বিষাদের শহর থেকে সম্পূর্ণ উলটো। তবে কোথাও একটা সমস্যা। আমি আর চার্লি সেটা ধরতে পারছিলাম না। আমরা যখন শহরটাকে ঘুরে দেখছিলাম তখন একজনের সাথে আমাদের পরিচয় হলো। সে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো আমি কি পথিক নাকি? আমি তাকে জানালাম।
সে হঠাত জিজ্ঞেস করলো, “ আচ্ছা দূঃখ কোথায় পাওয়া যায়?!”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেনো?!”

সে জানালো যে তাদের শহর হলো আনন্দের শহর। কিন্তু তা এখন ভয়ানক রূপ নিয়েছে। তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিআজ মারা গেছে। কিন্তু সে কাঁদতে পারছে না। দুখী হতে পারছে না। সে অসহায়ের মতো আমারদিকে তাঁকিয়ে আছে। আমি তাকে বিষন্ন শহরের গল্প শুনালাম। সে কিছু বুঝলো নাকি জানিনা, সে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

অবশেষে আমি এই শহরও ত্যাগ করলাম। এই শহরের দ্বাররক্ষী আমাকে হাসতে হাসতে বিদায় জানালো কিন্তু কেনো জানি মনে হতে লাগলো তার হাসি এবং সেই বিষন্ন শহরের দ্বাররক্ষীর দীর্ঘশ্বাস যেনো একসুতোতেই গাঁথা।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা কিছুদিন শহরে ভ্রমন বাদ রাখবো। তার চেয়ে বরং খোলা আকাশের নীচেই হেঁটে চলি মেঘ দেখতে দেখতে।
বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে। আমরা এখন একটা পাহাড়ী অঞ্চলে আছি। একে বেকে পেঁচানো রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে মাটি থেকে উপরে চলে যাচ্ছি আমরা। হঠাত করে চার্লি জোরে ডেকে উঠলো। ওর দৃষ্টি অনুসরন করে দেখলাম একজন রেলিং পার হয়ে রাস্তার বেশ কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছে সে লাফ দেয়ার পরিকল্পনা করছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা করছো?"
এই কথা শুনে সে মুখ ঢেকে বসে পড়লো।

আমি তাকে বললাম, “হে যুবক... তোমার উচিত একটি সুন্দর জায়গা আত্মহত্যার জন্য বেছে নেয়া। তুমি এই বিশ্রী জায়গাটি পছন্দ করে নিছক বোকামীর পরিচয় দিয়েছো!”
সে মুখ তুলে আমারদিকে রাগত স্বরে বললো, “তুমি কি আমার সাথে মজা করছো!”
“তা বলতে পারো কিছুটা করছি। অনেকদিন মানুষের সাথে কথা হয় না। ভাবছিলাম মজা করা ভুলে গিয়েছি। তবে হ্যা আমি কথাটি মিথ্যে বলিনি। তোমার অবশ্যই একটি সুন্দর এবং ভালো জায়গা পছন্দ করা উচিত। আমি আমার আত্মহত্যার জায়গা অবশ্যই বেছে নিবো কোনো সমুদ্রে। খুব উঁচু এক টিলা থেকে আমি সমুদ্রে ঝরে পড়বো।“
“তুমি কে?”
“আমি হলাম পথিক !!”
“তুমি যা বললে তা কি সত্যি বললে? সমুদ্র টিলা সম্পর্কে?”
“হু !! তবে আমার এখন তা করার ইচ্ছে নেই। যেদিন ঝরে পড়ার ইচ্ছে হবে সেদিন দেখা যাবে”।
“আমি হতাশ!”
“এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তুমি মানুষ, হতাশা তোমার থাকবেই!”
“তুমি বুঝবে না পথিক। তুমি এসব বুঝবে না!”
তখন আমি তাকে বিষাদের শহরের গল্প বললাম। বললাম আনন্দের শহরের কথাও। আরো বললাম আমার নিজের জন্মস্থান গম্ভীর শহরের কথাও।
সে জিজ্ঞেস করলো,“তার মানে বলতে চাচ্ছো আমি ভালো আছি ?!”
“অবশ্যই ভালো আছো।আমরা শহরবাসীরা এক বিরাট ভুল করে ফেলেছি। অনুভূতিগুলো যেখানে একসাথে থাকার কথাছিলো তা ভাগ করে আলাদা শহর বানিয়ে বসে আছি বহু বহু আগে থেকে। তোমাদের এখানে হয়তো তা এসে পৌছায়নি। তোমরা অনেক ভালো আছো। এমন হতে দিও না।“
সে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। হেসে আমাকে ধন্যবাদ জানালো। আমি মাথা নেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন সে বলে উঠলো, “পথিক চলে যাচ্ছো?”
আমি সায় দিলাম।
সে বলে উঠলো, “থেকে যাও না পথিক !!”

হঠাত করে আমি থমকে দাঁড়ালাম। আমার মনে পড়লো, এ কথা আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি। কেউ বলেনি থেকে যাও।আমি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। এই একটি বাক্য শুনতে চেয়েছি বহুকাল। অবশ্য আমিও পালিয়েছি অনেক শহর থেকে।
আমি চুপ করে আছি দেখে সে আবার বলে উঠলো, “সারাজীবন কি পালিয়ে বেড়াবে ??”
আমি অবাক হলাম সে কি করে জানলো কথাগুলো।

আমার নাম জিজ্ঞেস করলো সে। আমি নিজের নাম বলতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম বহুদিন আমি আমার নাম বলিনি। বহু বহুদিন। মানুষ আমাকে পথিক বলেই সম্বোধন করতো,আমিও তাই বলেই পরিচয় দিতাম। এতকাল নিজের নাম বলতে গিয়ে কিছুক্ষন আমি চুপ থাকলাম।
নাম শুনে সে বললো, “থেকে যাবে না লিলি?!”
আমি বললাম, “আমি ভীত!!”
সে জানালো, “কেনো?? আটকা পড়ে যাবে বলে? চিন্তা করো না। এরপর যখন পালাতে ইচ্ছে করবে তখন আমরা একসাথে পালিয়ে যাবো। ঝরে পড়তে ইচ্ছে করলে জানাবে, একসাথে সমুদ্রে ঝরে পড়বো বরং !!”
আমি ভাবতে লাগলাম, “ কিন্তু তার সাথে আটকা পড়ে গেলে?? তার কাছ থেকে যদি পালাতে চাই?!!”
কিন্তু তার দিকে আবার তাঁকিয়ে মনে হলো কিছু জায়গায় নিজেকে ধরা দিতে হয়তো কোনো সমস্যা হবার কথা না।

No comments:

Post a Comment